মুখোমুখি IntervieWপৃষ্ঠাসমূহ

মে ০৮, ২০১১

রবি এবং রবি

 
 রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন কিছু কি লেখা সম্ভব? এমন কিছু, যা আগে লেখা হয়নি? মনে হয় না। সব কথা বলা হয়ে গেছে। নানানভাবে বলা হয়েছে। তারপরেও দেখি, নতুন কিছু বলতে পারি কি না।
(ক) সিলেটে রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ এসেছেন সিলেটে, তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। বিপুল আয়োজন। তাঁকে ঘিরে প্রবল উত্তেজনা। সংবর্ধনার ভাষণ শুনে রবীন্দ্রনাথ হকচকিয়ে গেলেন। কারণ, ভাষণ দেওয়া হলো উর্দুতে। ভাষণে বলা হলো, এই বিশ্বকবিকে অশুদ্ধ উচ্চারণের সিলেটি বাংলায় সংবর্ধনা দেওয়া যায় না। এতে তাঁর কান পীড়িত হবে। তাই উর্দু ভাষায় ভাষণ দিচ্ছি। বক্তার নাম কাপ্তান মিয়া (খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ ঈওঅ, আসামের শিক্ষামন্ত্রী)।
বক্তৃতা শুনে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মুগ্ধ। তিনি কাপ্তান মিয়াকে শুদ্ধ উর্দুতে জবাব দিলেন। মূল বক্তৃতা বাংলাতেই দিলেন। রবীন্দ্রনাথ সিলেটের নামকরণ করলেন সুন্দর শ্রীভূমি।
(খ) প্রসঙ্গ সত্যেন বসু
আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হলো। অনেক আলাপ-আলোচনার মধ্যে হঠাৎ করে আইনস্টাইন জানতে চাইলেন, পদার্থবিদ সত্যেন বসু কেমন আছেন?
রবীন্দ্রনাথ সত্যেন বসুকে চিনতে পারলেন না। আইনস্টাইন অবাক। পদার্থবিদ্যার একজন বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টারকে রবীন্দ্রনাথ চিনতে পারছেন না?
রবীন্দ্রনাথ লজ্জা পেলেন। তাঁর লজ্জা তো আর আমাদের দশজনের লজ্জা না। তাঁর লজ্জাতেও ফসল উঠে আসে। তিনি বিজ্ঞান নিয়ে অনেক পড়লেন। একটি বই লিখলেন, 'বিজ্ঞানের কথা'। বিজ্ঞান নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের একমাত্র গ্রন্থ।
বইটি উৎসর্গ করলেন সত্যেন বসুকে। এই মানুষটিকে না-চেনার প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই করলেন।
(গ) অ্যাটম বোমা ও রবীন্দ্রনাথ
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফাংকলিন ডি রুজভেল্টকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন, অ্যাটম বোমা যেন বানানো হয়। চিঠিতে তিনি অ্যাটম বোমার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ এমন চিঠি লিখেছেন, তা না। কাজটি করেছিলেন তাঁর বন্ধু আইনস্টাইনের অনুরোধে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অ্যাটম বোমা বানানোতে রাজি করানোর প্রথম চিঠি আইনস্টাইনের লেখা (অক্টোবর, ১৯৩৯)। ম্যানহাটন প্রজেক্টে বোমা তৈরি হলো। ধ্বংস হয়ে গেল হিরোশিমা, নাগাসাকি। মানবদরদি এই কবির সেদিন কেমন লেগেছিল, তা জানা যায়নি। আইনস্টাইন অবশ্যি বৃদ্ধ বয়সে জাপানের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির এক জায়গায় লিখেছেন-
আমি এক বৃদ্ধ মানুষ। জাপানের স্কুল ছাত্রছাত্রীদের শুভ কামনা করছি এবং আশা করছি, একদিন তোমাদের প্রজন্ম আমাকে লজ্জায় ফেলবে (The world as I see it, Albert Einestin)
(ঘ) রবীন্দ্রকন্যা মীরা ও গোখরো সাপ
রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের কন্যার নাম মীরা দেবী। ইনি জগদীশ চন্দ্র বসুরও অতি কাছের ছিলেন।
মীরা দেবী বিয়ের স্নান করার জন্য গোসলখানায় ঢুকলেন। সেখানে প্রকাণ্ড এক গোখরো সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল। সে ছোবল মারার জন্য ফণা তুলল। ছোবল মারতে পারল না।
মীরা দেবীর বিয়ে সুখের হয়নি। তাঁকে কঠিন দুঃসময় পার করতে হয়েছে। তাঁর দুঃখে কাতর হয়ে একসময় রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন-
'আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনি ওকে কাটত তা হলে ও পরিত্রাণ পেত।' [সূত্র : মঞ্জুরী চৌধুরী; রবীন্দ্রনাথ এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা]
আহা রে, কত কষ্টেই না রবীন্দ্রনাথের মতো এমন স্নেহশীল পিতার মুখ থেকে এমন কথা বের হয়েছিল!
(ঙ) উপন্যাস 'গোরা'র উৎসর্গপত্র
ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর আদরের পুত্রকে বিয়ে দেন বিধবা প্রতিমা দেবীর সঙ্গে। এতে রবীন্দ্রনাথকে সমস্যায় পড়তে হয়। খোদ ঠাকুর পরিবারের মেয়েরাই রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেন। প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের ছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিমার বিয়ে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিয়ের তারিখ বসিয়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'গোরা' উৎসর্গ করা হয় রথীন্দ্রনাথকে।
(চ) রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বিবাহ
ব্রাহ্ম সমাজে হঠাৎ এক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মুখরোচক গুজব-রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিবাহ করতে যাচ্ছেন। কিছু পত্র-পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়। বিব্রত রবীন্দ্রনাথ 'বেঙ্গলি' পত্রিকার সাব-এডিটর পদ্মনীমোহন নিয়োগীকে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান। তিনি লিখেন-
'আমি দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে উদ্যত হইয়াছি এরূপ সম্পূর্ণ অমূলক সংবাদ কোনো বাংলা সংবাদপত্রে প্রচার করা হইয়াছে শুনিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। দয়া করিয়া আপনাদের পত্রে ইহার প্রতিবাদ প্রকাশ করিয়া আমাকে বাধিত করিবেন।'
রবীন্দ্রনাথ তথ্যকণিকা এখানেই শেষ করি। অজানা বা অল্প জানা কোনো তথ্য কি দিতে পেরেছি? চেষ্টা করেছি, এটুকু বলতে পারি।

পাদটীকা

অনেক দিন আগে বিটিভিতে একটি হাসির নাটক প্রচারিত হয়। নাটকের এক জায়গায় স্কুলটিচার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তারিখ কে জানে?
এক ছাত্র বলল, স্যার, ২২শে শ্রাবণ।
শিক্ষক বললেন, গাধা, কানে ধরে দাঁড়া। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু নেই।
কলকাতার 'দেশ' পত্রিকা এই নাটকটির উল্লেখ করে বাংলাদেশের মানুষদের রবীন্দ্রপ্রীতি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। কুইজ : বলুন দেখি, নাটকটি কার লেখা?                                      ---হুমায়ূন আহমেদ